শুরু হয়েছে অগ্নিঝরা মার্চ। বাঙালির জীবনে মার্চ মাস অন্তনির্হিত শক্তির উৎস। এ-মাসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ এর ৭ মার্চ সাবেক রেসর্কোস ময়দান – আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণের সময় উত্তাল ছিল জনসমুদ্র। লক্ষ কন্ঠের একই আওয়াজ উচ্চরিত হতে থাকে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ঢাকাসহ সারাদেশে পত পত করে উড়ছিল সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের পতাকা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, “...সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না...। ... রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো; এ-দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো – ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম; জয় বাংলা।”
অগ্নিঝরা মার্চ মাস বাঙালির স্বপ্নসাধের যৌক্তিক পরিণতির মাস। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক স্বপ্ন পূরণ হয়।
১৯৭১ সালে এসে রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে; যদিও এর গোড়াপত্তন হয়েছিল বহু বছর আগে। তারপরে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র শিক্ষা আন্দোলন এবং ৬৯’র গণ অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ১৯৭১ সালের মার্চে বাঙালির সেই স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতি স্পর্শ করে। এই মাসেই প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের গহীনে লালন করা তখনো অধরা ‘স্বাধীনতা’ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতোই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ – এই অমর পঙতিটি বাঙালি জাতিকে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় বলীয়ান করে তুলেছিল।
বাঙালি মূলত এই মার্চেই পাকিস্তানকে বিদায় জানায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৫ মার্চ রাতে কামান, মর্টার, রাইফেল নিয়ে অতর্কিতে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তাঁর সর্বশেষ বাণী বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়েছিলেন এই বলে – ‘এই হয়তো তোমাদের জন্য আমার শেষ বাণী। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। যে যেখানেই থেকে থাকো, যে অবস্থায়ই থাকো, হাতে যাঁর যা আছে, তা-ই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলো। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে, যতদিন পর্যন্ত না দখলদার পাকিস্তানিদের শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটিতে থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে।’
বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল বাঙালি জাতি। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছিল মার্চের প্রথম দিন থেকেই। এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। দুপুর ১টা ৫ মিনিটে রেডিও পাকিস্তানের সকল কেন্দ্রে একযোগে প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা প্রচার করা হয়। পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী, ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় হওয়ার কথা ছিল। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে যায় – দেশ আবার কঠোর সামরিক-ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে এবং সামরিক আইন কঠোর করে ভেতরে ভেতরে কোনো গভীর প্রস্তুতি চলছে।
দুপুরে রেডিওতে যখন জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার সংবাদ প্রচারিত হচ্ছিলো, তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানরত পাকিস্তান ও বিশ্ব একাদশের মধ্যে এক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতার ধারা বিবরণী চলছিল; তাই, মাঠের ক্রিকেট দর্শকরাই রেডিওতে প্রথম ইয়াহিয়ার এই ঘোষণা শুনতে পান। রেডিওতে খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরে সর্বপ্রথম সংগঠিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল স্টেডিয়ামের হাজার হাজার ক্রিকেট-দর্শক। তাঁরা সমস্বরে চিৎকার করে ওঠেন – ‘জয় বাংলা’ বলে; ধাওয়া করেন পশ্চিম পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের এবং শ্লোগানে উত্তাল হয়ে মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে পড়েন।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের খবর শুনে পিআইএ’র বাঙালি কর্মচারীরাও জনসাধারণের সঙ্গে রাস্তায় নেমেছিলেন। জগন্নাথ কলেজ ও পার্শ্ববর্তী কায়েদে আযম কলেজের ছাত্ররাও লাঠিসোটা হাতে রাস্তা প্রদক্ষিণ করতে থাকে। আদমজী মিলের শ্রমিকরা চাকা বন্ধ করে শোভাযাত্রা সহকারে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। মিছিলকারীরা এ-সময় বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন – সেটা জানতে চায়। অবশেষ তাঁরা জানতে পারেন, বঙ্গবন্ধু এখন হোটেল পূর্বাণীতে। সেখানে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক হওয়ার কথা। মিছিলের পর মিছিল এগিয়ে চলে হোটেল অভিমুখে। লাখ লাখ মানুষের চিৎকার আর মিছিলে হোটেল পূর্বাণীর চত্বর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সকলেই বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী নির্দেশ শোনার জন্য উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, তিনি এক্ষণি চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তিনি মাওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, আতাউর রহমান খানসহ অন্যান্য নেতার সঙ্গে আলোচনা করবেন।
তবে, বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে বলেছিলেন, অধিবেশন স্থগিত হওয়ার বিষয়টি তিনি বিনাচ্যালেঞ্জে যেতে দিতে পারেন না। তিনি বলেন, আগামী ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ বুধবার সারাদেশে হরতাল পালন করা হবে।
বঙ্গবন্ধুকে সাংবাদিকরা জানান, জনগণ তো রাস্তায় নেমে পড়েছে, তিনি তাঁদেরকে কি বলবেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে বলবো।’
এরই মধ্যে শহরের বিভিন্ন অলিগলি থেকে শত শত মিছিল পল্টন ময়দানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে জমায়েত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে এই জমায়েত জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। এখানে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সমাবেশে বক্তৃতা করেন সাবেক ছাত্রনেতা ও নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমদ। তিনি বলেন, আর ছয় দফা, ১১ দফা নয় – এবার বাংলার মানুষের এক দফার সংগ্রাম শুরু করবো। আর এই এক দফা হলো – বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব।
অগ্নিঝরা মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকে বাংলাদেশ পথ নাটক পরিষদ ছয়দিনব্যাপী পথনাটক উৎসব আয়োজন করেছে। এদিন বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে উৎসব উদ্বোধন করবেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৩৮ জন নাট্যকারকে যাদের রচিত পথ নাটক বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ পথ নাটক পরিষদের বিভিন্ন আয়োজনে অভিনীত হয়েছে, তাঁদের সম্মাননা জানানো হবে। ৬ মার্চ পর্যন্ত চলবে এই উৎসব।
