অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার যে-স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে, তা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তোমরা এর থেকে বেরিয়ে যেও না।’ তিনি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছাত্রদের সার্বক্ষণিক কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান। প্রধান উপদেষ্টা রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) তেজগাঁও অবস্থিত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ছাত্র সংগঠক এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় এ-কথা বলেন। খবর – স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের।
প্রধান উপদেষ্টা সভার শুরুতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ ও আহত শিক্ষার্থীদের কথা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। ড. ইউনূস এ-সময় হতাহতদের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাঁকে কাঁদতেও দেখা গেছে।
অধ্যাপক ইউনূস গত ১৫ বছরের অপশাসনের কথা স্মরণ করে শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘এতদিন তাঁরা চুপচাপ শুয়ে শুয়ে স্বপ্নের মধ্যে ছিল এবং আনন্দ সহকারে লুটপাট করে যাচ্ছিলো। এঁরা কী এখন চুপচুপ বসে থাকবে – না, তাঁরা খুব চেষ্টা করবে আবার তোমাদেরকে দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার; চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবে না। কাজেই যে-কাজ শুরু করেছো, তা সমাপ্ত না-হওয়া পর্যন্ত এর থেকে বেরিয়ে যেও না।’
দেশের সফল অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে নোবেল বিজয়ী ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত এই সুযোগ আসেনি। তবে সুযোগ যেন হাতছাড়া না-হয়। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে বাংলাদেশের আর কোনো ভবিষ্যত থাকবে-না; রাষ্ট্র আর থাকবে না। কাজেই, এটা শুধু রাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর সম্মানিত রাষ্ট্র হিসেবে যেন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটা করতে হবে।’
তরুণরা কোন যাদুমন্ত্রে বাংলাদেশে বিপ্লব সংগঠিত করেছে – তা দেখতে সারাদুনিয়ার মানুষ এদেশে আসবে এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দুনিয়ার মানুষ দেখতে আসবে, তোমাদের কাছ থেকে শিখতে আসবে। তোমাদের কাছে জানতে চাইবে – কোন মন্ত্র দিয়ে এই বিপ্লব করেছো। এই মন্ত্র তারা শিখতে চাইবে।’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘তোমাদের মন্ত্র কী – সেটা হয়ত তোমরা বুঝতে পারছো না। এটা একটা বড় মন্ত্র। এই মন্ত্র ধরে রাখো। মন্ত্র যদি শিথিল হয়ে যায়, আমাদের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। সেই দুঃখ যেন আমাদেরকে দেখতে না-হয়।’
অভ্যুত্থান-পরবর্তীতে তরুণরা দেশের হাল ধরেছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, তরুণরা দেশের হাল ধরেছে, তাঁরা অনন্য এক বাংলাদেশ তৈরি করে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
শিক্ষার্থীদৈর নিজ-নিজ চিন্তায় অনড় থাকার পরামর্শ দিয়ে সরকার-প্রধান বলেন, তোমাদের চিন্তা স্বচ্ছ ও সঠিক। তোমরা নিজ নিজ চিন্তায় অনড় থাকো। কেউ যদি স্বপ্ন পূরণের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেয় – সেটা গ্রহণ করো না।
তিনি বলেন, স্বপ্ন বাস্তবায়ন থেকে যদি আমরা দূরে সরে যায়, দেশবাসী তাহলে আমাদেরকে সতর্ক করে দেবে। আমাদের কারোর কোনো ইচ্ছা নেই – এই স্বপ্নের বাইরে যাওয়ার। আমাদের সার্বক্ষণিক কাজ হলো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। একযোগে এই কাজ করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেখছি আর ভাবছি – কি একটা স্বপ্ন আমাদের সবার সামনে, জাতির সামনে তোমরা নিয়ে এসেছো। যাঁরা শহিদ হয়েছে – তাঁদের স্মরণ করি। যারা শহিদ হয়েছে – তাঁরা চলে গেছে। তোমাদের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম – তোমরাও শহিদ হয়ে যেতে পারতে। শহিদরা আজ আমাদের সঙ্গে বসতে পারতো; সেই সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়নি।
আহতদের হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে গিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘যখন হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের দেখার জন্য যাই, তাঁদের দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। একটা ছেলে, একটা মেয়ে এইরকমভাবে কিভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে! এই দিকে পা চলে গেছে, ওই দিকে মাথা।’
আবেগাপ্লুত কন্ঠে ড. ইউনূস বলেন, ‘একজন তাজা তরুণ রংপুরে আমাকে বললো, ফুটফুটে একটা ছেলে, স্যার আমি সারাজীবন ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলাম। ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলাম। এখন দেখেন – আমার পা কেটে ফেলেছে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে – স্যার ক্রিকেট খেলবো কি করে? ক্রিকেট তাঁর মাথা থেকে যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘আহতদের যতবার দেখি – ততবার মনে প্রশ্ন জাগে, কি বাংলাদেশ আমরা বানিয়েছি যে – এতগুলো তাজা প্রাণ, তাঁদেরকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো। আমরা যাঁরা আজকে এখানে বসে কথা বলছি, তাঁদের একমাত্র দায়িত্ব – তাঁদের এই ত্যাগ, এই জীবনের মূল্যের স্বপ্ন পূরণ করা।’
নিউরোসায়েন্সস হাসপাতালে আহতদের দেখতে যাওয়ার কথা স্মরণ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘গতকাল একটা হাসপাতালে গেলাম; আবার সেই দৃশ্য – কচি কচি প্রাণ, মাথার খুলি উড়ে গেছে। মাথার অর্ধেক নাই, গুলি মাথার ভেতর রয়ে গেছে। রংপুরের হাসপাতালের দৃশ্য, এক্স-রে’তে দেখা যাচ্ছে ওখানে দাগ ছোট ছোট ফুটো করা। আমি বুঝতে পারলাম না – আমাকে কি দেখাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম – এগুলো কি? এতগুলো গুলি তাঁর শরীরে রয়ে গেছে, সে বেঁচে আছে ...। যতবার দেখি যতবার শুনি, আবার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হয় – যে-স্বপ্নের জন্য তাঁরা প্রাণ দিয়েছে, সেই স্বপ্নকে আমরা বাস্তবায়ন করবো। এটার থেকে আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।’
তিনি বলেন, আমাদের যোগ্যতা না-থাকতে পারে, ক্ষমতা না-থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা রইলো, আমরা স্বপ্ন পূরণ করবো। হাসপাতালের দৃশ্য এবং আন্দোলনের প্রতিদিনের ঘটনা মানুষকে জানাতে হবে বোঝাতে হবে – এর পেছনে কি ছিল।
সভায় উপস্থিত ছিলেন – আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।