তিনজন অর্থনীতিবিদ – ডেরন আসেমোগ্লু, সাইমন জন্সন ও জেমস এ রবিন্সনকে ২০২৪ সালের অর্থনীতি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস সোমবার (১৪ অক্টোবর) বলেছে, প্রতিষ্ঠান কিভাবে গঠিত হয় এবং সমৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে – তা নিয়ে গবেষণার জন্য এই তিন অর্থনীতিবিদকে পুরস্কার দেওয়া হবে। খবর – আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের।
অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে পুরস্কারের কমিটির চেয়ারম্যান জ্যাকব সভেনসন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এই বছরের বিজয়ীরা বিভিন্ন দেশের সমৃদ্ধিতে বিশাল ব্যবধানের কারণ সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, এর গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো – সামাজিক প্রতিষ্ঠানে দৃঢ় পার্থক্য।
নোবেল কমিটি যা বলতে চেয়েছে, তার সারামর্ম হলো – এবারের পুরস্কার বিজয়ীরা মূলত ধনী-গরিব বৈষম্যের নিদান ও দাওয়াই আবিষ্কার করেছেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো দেশ এগিয়ে থাকে, আবার কোনো দেশ পিছিয়ে থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ দেশ এখন সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি ধনী। যদিও গরিব দেশও ধনী হয়েছে, তবু তাঁরা সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর সঙ্গে তাল মেলাতে পারে-না। একটি বড়সড় ব্যবধান লেগেই থাকে। এই বৈষম্যের নিদান খুঁজতে গিয়ে নতুন অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছেন এবারের নোবেল বিজয়ী তিন অর্থনীতিবিদ। নতুন ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন; আর তা হলো – সমাজিক প্রতিষ্ঠানের হেরফের।
ইউরোপিয়রা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে গিয়ে যে-রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই তিন অর্থনীতিবিদ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমৃদ্ধির সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার পার্থক্য নিরসন এবং এসব প্রতিষ্ঠানকে বদলে দেওয়ার উপায়ও হাজির করেছেন।
নোবেল পুরস্কারের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইউরোপিয়রা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করার পরে সেসব দেশের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বদলে যায়। সবখানে যে-এই পরিবর্তন একইভাবে হয়, তা নয়। কোনো অঞ্চলে উপনিবেশবাদীদের লক্ষ্য ছিল – স্থানীয় জনগণকে শোষণ করে নিজেদের সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করা। আরেকদিকে, উপনিবেশ স্থাপনকারীরা অনেক দেশে ইউরোপিয় অভিবাসীদের দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণ নিশ্চিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।
এভাবে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক-ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এসব দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গতিপথ ঠিক হয়েছে। এবারের নোবেলজয়ী তিন অর্থনীতিবিদ এই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন – উপনিবেশ স্থাপনের সময় যেসব দেশ গরিব ছিল, সেখানে মূলত অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। কালপরিক্রমায় এসব দেশের মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি এসেছে। সাবেক উপনিবেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশ একসময় ধনী ছিল, সেগুলো গরিব হয়ে গেছে এবং গরিব দেশগুলো ধনী হয়ে গেছে। এই গড়মিলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ – উপনিবেশবাদীদের প্রতিষ্ঠান গড়ার নীতি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যেসব দেশে শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সেসব দেশের তেমন একটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়নি এবং তাঁরা নিম্নআয়ের ঘেরাটোপে আটকা পড়েছে। বিষয়টি হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে সেই সমাজের সবাই দীর্ঘমেয়াদি সুফল পায়; তবে শোষণমূলক ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে শুধুমাত্র হাতেগোনা কিছু ক্ষমতাধর মানুষ স্বল্প মেয়াদে লাভবান হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ গুটিকয়েক মানুষের হাতে থাকলে কেউই তাঁদের প্রতিশ্রুত ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সংস্কারে ভরসা পায়-না। নোবেল জয়ী তিন অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, ফলত এসব দেশ উন্নতিতে পিছিয়ে থাকে।
২০২৪ সালের নোবেল বিজয়ী তিন অর্থনীতিবিদের মধ্যে দু’জন – ডেরন আসেমোগ্লু ও জেমস রবিনসন ‘হোয়াই নেশান্স ফেইল: দি অরিজিন্স অফ পাওয়ার, প্রসপারিটি অ্যান্ড পোভার্টি’ শীর্ষক বিশ্বখ্যাত গ্রন্থের লেখক।
আসেমোগ্লুর বলেন, সমৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সক্ষমতা বা অক্ষমতা। তাঁর মতে, কোনো রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক হলে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের শরিক হওয়ার সুযোগ থাকলে, সেই সমাজ বা রাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের ধারা সূচনা করতে পারে। শুধুমাত্র মেধাভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানই হতে পারে রাজনীতিক বা আমলাদের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠন ঠেকানোর রক্ষাকবজ।
বইয়ের লেখকদ্বয় মেধাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে দেখিয়েছেন, আফ্রিকার অনেক দেশে এখন আর শ্বেতাঙ্গদের রাজত্ব না-থাকলেও মুষ্টিমেয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করে সম্পদ লুটে নিচ্ছেন। তাঁরা এই বাস্তবতার নিরিখে প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
প্রতিবছর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যু দিবস – ১০ ডিসেম্বর তারিখে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কারের অর্থ তুলে দেওয়া হয়। প্রতি ক্ষেত্রে পুরস্কার বিজয়ীরা একটি স্বর্ণপদক, শংসাপত্রসহ একটি ডিপ্লোমা এবং বর্তমানে ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার পেয়ে থাকেন।
নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রতিবছর ৩০০ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর যাচাই-বাছাই শেষে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
গত বুধবার রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিড বেকারকে কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজাইনের জন্য’ এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডেমিস হাসা বিস ও জন এম. জাম্পারকে ‘প্রোটিন গঠন পূর্বাভাসের জন্য’ যৌথভাবে ২০২৪ সালের রসায়নে নোবেল পুরস্কারজয়ী ঘোষণা করে।
বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কোরিয়ার ম্যান বুকারবিজয়ী কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, ছোট গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হান কাংকে ২০২৪ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।