সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ না থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জিনগত, ভাইরাস, খাবারে বিষ-জাতীয় পদার্থের উপস্থিতি, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ সহ পরিবেশগত সমস্যায় শিশুদের ক্যান্সার হয়। তবে প্রাথমিকভাবে এ রোগ শনাক্ত করা গেলে বেশিরভাগ শিশুরই ভালো হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। শিশুদের ক্যান্সার মোকাবিলায় সবার আগে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
ক্যান্সার অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন সংক্রান্ত রোগসমূহের সমষ্টি। বর্তমানে প্রায় দুই শত প্রকারেরও বেশি ক্যান্সার রয়েছে। প্রত্যেক ক্যান্সারই আলাদা আলাদা এবং এদের চিকিৎসা পদ্ধতিও আলাদা। বর্তমানে ক্যান্সার নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে নতুন নতুন অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক শিশু ক্যান্সারে সংক্রান্ত একটি সংস্থা জানায়, বিশ্বে প্রতিবছর দুই লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। উন্নত দেশগুলোতে শিশুদের বেঁচে থাকার হার শতকরা আশি ভাগ। মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে আক্রান্ত হয় সিংহভাগ, শতকরা আশি ভাগ। আর ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের বেঁচে থাকার হার মাত্র পাঁচ ভাগ। আমাদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে না পারলে ২০৩০ সালে এ হার দাঁড়াবে তেরো শতাংশে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কিন্তু উদ্বেগের বিষয় প্রতিবছর ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছেই। শিশুদের ব্লাড ক্যান্সার বেশি হলেও নসিকাগ্রন্থি, কিডনি এবং চোখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া শিশুর সংখ্যাও কম নয়। বেশির ভাগ শিশুর ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য। শনাক্ত করা গেলে ও উন্নত চিকিৎসা পেলে ৭০ শতাংশ রোগী সেরে ওঠেন। কিন্তু মাত্র বিশ শতাংশ রোগী উন্নত চিকিৎসার সুযোগ পান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি প্রফেসর ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশু ক্যান্সার রোগীদেরও নিরাময় করা যায়। ক্যান্সার কঠিন ব্যাধি। শুরুতেই চিহ্নিত করা গেলে ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব। সরকারের পক্ষ থেকে এ হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের মাঝে শিশু ক্যান্সারে সচেতনতা বৃদ্ধিরও দরকার রয়েছে। এক্ষেত্রে মিডিয়াসহ সবার সহযোগিতা ও যোগাযোগ বৃদ্ধি করা দরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার যেমন পালং শাক, ব্রুকলি, ডিমের কুসুম, মটরশুটি, কলিজা, মুরগীর মাংস, কচুশাক, কলা, মিষ্টিআলু, কমলা, শালগম, দুধ, বাঁধাকপি, বরবটি, কাঠবাদাম মতো ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম এবং আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে। কেবলমাত্র যদি হাড়ের ক্যান্সারে কোনও শিশু আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে তার সুস্থ হবার সম্ভাবনা একটু কম থাকে, কারণ হাড়ের ক্যান্সার ছড়িয়ে যায় খুব দ্রুত। তাই শিশুদের ক্যান্সার হলে পরিবারকে ভেঙ্গে না পরে দ্রুত তার চিকিৎসা করাতে হবে সঠিক উপায়ে, তাহলেই তাকে সারিয়ে তোলা সম্ভব।
খুব ক্লান্ত বোধ করা, ক্ষুধা কমে যাওয়া, শরীরের যে কোনজায়গায় চাকা বা দলা দেখা দেয়া, দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা গলা ভাঙ্গা, মলত্যাগে পরিবর্তন আসা (ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা মলের সাথে রক্ত যাওয়া), জ্বর, রাতে ঠান্ডা লাগা বা ঘেমে যাওয়া, অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমা, অস্বাভাবিক রক্তপাত হওয়া, ত্বকের পরিবর্তন দেখা যাওয়া এসব সাধারণ কিছু লক্ষণ ছাড়াও আছে আরো অনেক জানা অজানা লক্ষণ। প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার রোগ সহজে ধরা পড়ে না, ফলে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভালো কোন চিকিৎসা দেয়াও সম্ভব হয় না। তাই সবাইকে ক্যান্সারের বিভিন্ন লক্ষণ, উপসর্গ সম্পর্কে নূন্যতম সাধারণ জ্ঞান থাকা উচিত। আর সেটা সম্ভব হলে আমাদের চারপাশের বা আপনজনের মাঝে এমন লক্ষণ দেখা দিলে প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসকের সাহায্য নেয়া সম্ভব।
বেসরকারি সংস্থা "ওয়াল্ড চাইল্ড ক্যান্সার" এর বাংলাদেশের অনুষ্ঠান সমন্বয়কারী রিজওয়ানা হোসাইন বলেন, “শিশুদের ক্যান্সারের রোগনির্ণয়, চিকিৎসার এবং উন্নত যত্ন করার লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে তারা কাজ করছে। সাথে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য সক্ষমতা তৈরী করতে সরকারি ও বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গুলোতে সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে অনেক উপভোগ্য কার্যকলাপ পরিচালনা করা হয়; যেমন শিল্প ও অঙ্কন প্রতিযোগিতা। সাধারণ মানুষের মাঝে ক্যান্সারের সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ এ ক্যান্সার সচেতনতা প্রচারণা পরিচালিত হচ্ছে। "ওয়াল্ড চাইল্ড ক্যান্সার" সরকার এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় বাংলাদেশে এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে চায়।
বলাই বাহুল্য প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরলে এই রোগ সারানোর সম্ভাবনা অনেকাংশ বেড়ে যায়। আসুননা সবাই মিলে সচেতনতা বাড়াই, অন্যকে জানাই। আমাদের মাঝে থেকে আর একটি নিষ্পাপ ফুলও আমরা ঝড়ে যেতে দেবোনা, এটাই হোক আজকের প্রত্যয় ।
লেখক - তাওহীদ হাসান, ঢাকা।