প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোবাইল ফোন সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৩৬ লাখ পরিবারের মধ্যে নগদ সহায়তা বিতরণের দ্বিতীয় পর্ব চালু করেছেন। তিনি আজ সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম, ভোলা ও জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসন অনুষ্ঠানে সংযুক্ত ছিল। প্রতিটি পরিবার এই মহামারিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ঈদ উপহার হিসেবে ২,৫০০ টাকা পাচ্ছে, যার জন্য মোট ৯১২.৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। খবর স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সর্বদা দেশের জনগণের পাশে থাকে। সেটা ক্ষমতায় বা বিরোধীদল, যে-অবস্থানেই থাকুক না কেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় চিন্তা করি কিভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াব, মানুষকে সহযোগিতা করবো। আওয়ামী লীগ তাঁর (জাতির পিতার) পদাঙ্ক অনুসরণ করেই কাজ করে যাচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সবসময় দুর্গত মানুষের পাশে আছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তার পাশাপাশি দলীয়ভাবেও আমরা মানুষের পাশে আছি।’
তিনি বলেন, ‘করোনায় কৃষকের ধান কাটার সমস্যা ছিল। আমি বলার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ মানুষের ধান কেটে দিয়েছে। এভাবে সব দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আওয়ামী লীগ মানুষের পাশে থাকে।’
দুর্যোগে মানুষের পাশে না দাঁড়িয়ে শুধু সমালোচনার স্বার্থেই সরকারের ঢালাও সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে এদিনের ভাষণে তীব্র ক্ষোভও প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, যাঁরা করোনাকালীন সরকারের কাজ নিয়ে সমালোচনা করছেন, সরকার এটা করেনি, সেটা করেনি, তাঁদের কাছে আমার – প্রশ্ন নিজে কয়টা লোককে সহায়তা করেছেন সেই হিসেবটা পত্রিকায় দিয়ে দেন। তাহলে মানুষ আস্থা পাবে, বিশ্বাস পাবে; সেটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
আজকে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে সাড়ে ৩৬ লাখ পরিবারকে নগদ সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি সরকারের দুর্যোাগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ত্রাণ বিতরণ ও পুণর্বাসন কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। ৬৪ জেলায় ইউনিয়ন হিসেবে করে জেলা প্রশাসকদের কাছে কিছু টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে যেকোনো জায়গায় তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে তাঁরা যেন সেটা ব্যয় করতে পারেন এবং দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের অনুকূলে ১০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও শিল্পী, কলা-কুশলী থেকে শুরু করে মসজিদ-মাদ্রাসায় অনুদান দেওয়া হয়েছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি তাঁর সরকারের অনুদানের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানসহ সকলকে দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানান। এ-সময় তিনি করোনা মোকাবেলায় টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করা, ভিড় এড়িয়ে চলাসহ স্বাস্থ্যবিধিগুলো যথাযথভাবে অনুসরণে জণগণের প্রতি তাঁর আহ্বান পুণর্ব্যক্ত করেন।
এদিন, করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, দিনমজুর, শ্রমিক, গৃহকর্মী, রিকশা ও ভ্যানচালক, মোটরশ্রমিকসহ কর্মহীন বিভিন্ন পেশার ক্ষতিগ্রস্ত ৩৬ লাখ ৫০ হাজার পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ অর্থ বিতরণ করা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী তিন দিনের মধ্যে নগদ, বিকাশ, রকেট ও শিউরক্যাশের মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে জিটুপি (গর্ভনমেন্ট টু পার্সন) ভিত্তিতে ২,৫০০ টাকা করে পৌঁছে যাবে এসব পরিবারের কাছে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গণভবন থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, এমপি, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করছে সরকার। ক্ষতিগ্রস্থ ১ লাখ কৃষক পরিবারের মোবাইল ফোনে এই সাহায্য পৌঁছে যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ৪ এপ্রিল সংঘটিত ঝড়ো হাওয়া, শিলাবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ে দেশের ৩৬টি জেলার ৩০ লাখ ৯৪ হাজার ২৪৯ হেক্টর ফসলি জমির মধ্যে ১০ হাজার ৩০১ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ এবং ৫৯,৩২৬ হেক্টর ফসলি জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়। এতে, ১ লাখ কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা হারে আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি বিবেচেনার সুপারিশ করে কৃষি মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর করোনা-মহামারির কারণে যেসব নিম্নআয়ের লোকজন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং কর্মহীন হয়ে পড়েছিল, তাঁদের সহায়তার জন্য ‘নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান’ কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনা-মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫ লাখ নিম্নআয়ের পরিবারকে পরিবারপ্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা করে ৮৮০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি এই অর্থ দেওয়া হয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যাঁরা প্রতিদিন বক্তৃতা-বিবৃতি বা আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও করে যাচ্ছে, দুর্যোগে মানুষের পাশে কোথায় তাঁরা? কয়জন দুর্গত মানুষের মুখে তারা খাবার তুলে দিয়েছে? কয়জন মানুষের পাশে তাঁরা দাঁড়িয়েছে? কয়জন মানুষের কাফনের কাপড় তুলে দিয়েছে? কেউ নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, এখন তাঁরা ঘরে বসে বসে বিবৃতিই দিয়ে যাচ্ছেন। আর আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন, যখন তাঁদের বুদ্ধি খোলে কিংবা পরামর্শ দেন, তার আগেই কিন্তু আমাদের আওয়ামী লীগ সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে নেয়।’
সরকার বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শের জন্য বসে না থেকে মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারণ, এই দেশটা আমাদের। এই দেশটা আমার বাবা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। রাজনীতি আমাদের জনগণের জন্য, জনগণের কল্যাণের জন্য। এই কথাটা আমরা ভুলি না।’
সরকার-প্রধান বলেন, ঈদ উৎসব তো আছেই। এটা সবাই উদযাপন করবেন। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। ঈদের আনন্দ করবেন। কিন্তু যাঁরা মারা গেছে, তাঁদের কথাও ভাবুন। নিজের জীবন বিপন্ন করে উৎসব নয়। মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে যাবেন না। গরম পানির ভাপ নেওয়া, গরম পানি খাওয়ার মতো বিষয়গুলো যত্ন সহকারে মানার জন্য তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাইরে থেকে ভাইরাস নিয়ে এসে নিজের পরিবারের ক্ষতি করবেন না। আমরা যে-নির্দেশনাগুলো দিচ্ছি – সেগুলো মানতে হবে। কোয়ারেন্টিনের বিষয়গুলো মানতে হবে। আপনারা সচেতন হোন, স্বাস্থ্যবিধি মানুন। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আমরা সচল রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি।’
অর্থ বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আমরা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যাঁরা ভাসমান মানুষ, নির্মাণ শ্রমিক, গণপরিবহন শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, দিনমজুর, ঘাট শ্রমিক, নরসুন্দরসহ যাঁরা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে জীবিকা নির্বাহ করেন, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার অসহায় মানুষ, তাঁদেরকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নগদ সহায়তা দিচ্ছি। এতে অন্য কেউ টাকা পয়সা এদিক ওদিক করতে পারবে না।’
সরকার-প্রধান বলেন, ‘আমাদের ছোট ভূখণ্ডে অধিক জনসংখ্যা। কিভাবে এই জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেওয়া যায়, অপর দিকে তাঁদের খাদ্যের ব্যবস্থা, তাঁদের জীবনটাকে সচল রাখার ব্যবস্থা, সেটা কিভাবে করা যায় – আমরা সেই প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি। সে-কারণে এই অসহায় বঞ্চিত মানুষের পাশে আমরা দাঁড়িয়েছি।’
তিনি এ-সময় দেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী ফেলে না রাখার এবং সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে সকলকে মনোনিবেশ করারও আহ্বান জানান।
এবারের নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অর্থ বিভাগের বাজেটের অধীন ‘করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় তহবিল’-এ বরাদ্দ অর্থ থেকে যোগান দেওয়া হচ্ছে। উদ্বোধনের প্রথম দিনে ২২ হাজার ৮৯৫ পরিবার এই অর্থ সহায়তা পেয়েছেন।