loader image for Bangladeshinfo

শিরোনাম

  • চিন্তার ক্ষেত্রে ভেঙে পড়া সেতুগুলো মেরামত করতে হবে: সংস্কৃতি উপদেষ্টা

  • বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হতে চলেছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

  • বিএনপি ঐকমত্য চায়, সঙ্গে নির্বাচনী রোডম্যাপ

  • ক্যারিয়ার সেরা র‌্যাংকিংয়ে নাহিদা; উন্নতি পিংকি, জ্যোতি ও সুপ্তার

  • বিপিএল টি-টোয়েন্টির থিম গ্রাফিতি ও থিম সং প্রকাশ

’শুনতে কি পাও!’’, এবার তবে শোনানোর পালা


’শুনতে কি পাও!’’, এবার তবে শোনানোর পালা

‘’আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,

থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর৷

পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,

এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই৷

আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,

আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ৷’’

খুলনার দকোপ থানার সুতারখালি গ্রাম যেন কবি বন্দে আলী মিয়ার সেই বিখ্যাত কবিতার মতোই বাংলার অনিন্দ্যসুন্দর একটি গ্রাম। সুন্দরবনের কাছে প্রত্যন্ত উপকূলে, বিশাল এক আকাশের নিচে সে গ্রামে বাস করে একদল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। আক্ষরিক অর্থে সাধারন এসব মানুষের অসাধারন জীবন উপাখ্যান ‘’শুনতে কি পাও!’’ নামক প্রামান্যচিত্রে তুলে ধরেছেন পরিচালক কামার আহমাদ সায়মন।

চার পুরুষের আবাদে প্রায় একশো পরিবারের বাস এই সুতারখালি গ্রামে। এ গ্রামেই ঘর বেঁধেছিলো রাখী আর সৌমেন, জন্ম হয়েছিলো তাদের ভালোবাসার সন্তান রাহুল এর। ২০০৯ সালের মে মাসে প্রলয়ঙ্কারী ‘আইলায়’ তছনছ হয়ে যায় পুরো দক্ষিনবঙ্গের চরাঞ্চল। জলোচ্ছাস ভাসিয়ে নিয়ে যায় চরপারের মানুষের ঘর বাড়ি সহায় সম্বল। বাদ পড়েনি রাখী-সৌমেনের পরিবারটিও।

এরপর বেঁচে থাকার তাগিদে আগের চেয়েও কঠিন জীবনসংগ্রামে নামে রাখী আর সৌমেন। তাদের আশ্রয়ের জন্য জোটে সরু রাস্তার দুপাশের ফাঁকা যায়গাটি। দিন যায়, মাস যায়, ঋতু বদলায়। নতুন করে নিজের ঘর বাঁধার আশায় বুক বাঁধে এ অঞ্চলের প্রত্যেকটি মানুষ। সারা গ্রামের সমস্ত শক্তি দিয়ে নেমে পড়ে বাঁধ নির্মানে। প্রকৃতি যেন হার মেনে যায় তাদের এ বেঁচে থাকার অদম্য স্পৃহার কাছে।

ইউরোপীয় প্রামাণ্য নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ট্যু স্টিন মুলার এ চলচ্চিত্র সম্বন্ধে বলেছেন, এটি তাকে সত্যজিত রায়ের অপু উপাখ্যান মনে করিয়ে দেয়। আমার ব্যক্তিগতভাবে চলচ্চিত্রটি দেখার সময় মনের দৃশ্যপটে উকি দিয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে কিংবদন্তী উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝির সেই কুবেরের সংগ্রামী জীবন। এ তথ্যচিত্রের অন্যতম প্রধান চরিত্র সৌমেন পেশায় কুবেরের মত জেলে না হলেও চরাঞ্চলের মানুষের মত আছে তাদেরমধ্যে মিল। তারা সংগ্রামী, প্রকৃতির আজন্ম ভাঙ্গা গড়ার খেলায় নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় নিজেদের। প্রাকৃতিক দূর্যোগ, তদুপরি অভাব অনটনে ক্লিষ্ট জীবনে তাদেরও আছে আনন্দ বিনোদন উপভোগের ইচ্ছা। তাইতো শত অভাব সত্ত্বেও পূজোর সময়ে তারা ছুটে যায় পুজো মন্ডপে, পুজো পালন করে সাধ্যমত। ছেলে রাহুলের বায়নায় খেলনা প্লেন কিনে দিতে না পারলেও বেলুন কিনে শান্ত করে তাকে। তবুও ছেলেকে পুজোতে নতুন জামা না কিনে দিতে পারার আফসোস বয়ে বেড়ায় সৌমেন।

আজ থেকে কয়েক বছর আগে নির্মাতা কামার আহমাদ সায়মন, তার স্ত্রী চলচ্চিত্রটির প্রযোজক সারা আফরীন তাদের ফিল্মমেকিং টিম নিয়ে খুলনার সুতারখালি গ্রামে যান। দীর্ঘ বিশ মাসের অক্লান্ত চেষ্টায় তুলে আনেন সে অঞ্চলের জীবন উপাখ্যান। এরপর আরো বছরখানেক ধরে চলে সম্পাদনার কাজ। নিজের লেখা এক আর্টিকেলে পরিচালক সায়মন বলছিলেন শ্যুটিং এর সময় তার কষ্টের কথা, অনুভুতির কথা। কুড়িটি মাস কম সময় নয়। শহুরে সভ্যতার লোভে জর্জরিত সময়ে আত্মজনেরা একসময় তাকে প্রশ্ন তুলেছিলো, ‘কী করো তুমি?’ তিনি নিরুত্তাপ হয়ে চলে গিয়েছিলেন সেইসব প্রাকৃতজনের খোঁজে। পুজোর দৃশ্যায়নে দুদিন আগের ব্যাটারির চার্জার জ্বলে যাওয়ার ঘটনা,  কিংবা আচমকা জেনারেটর নষ্ট নওয়া, মনমতো শট তোলার ইচ্ছায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকায় সহকারীদের বিরক্তি। কোনকিছুই দমাতে পারেনি তাকে।

২০১৩ সালের এপ্রিলে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামাণ্যচিত্র উৎসব ‘সিনেমা দ্যু রিল’- এর ৩৫তম আসরে মূল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে শ্রেষ্ঠ সিনেমার জন্য সর্ব্বোচ্চ পুরষ্কার ‘গ্রাঁ প্রি’ জয় করেছে ‘শুনতে কি পাও!’। এ ছাড়া ফিল্ম সাউথ এশিয়ার ‘জুরি অ্যাওয়ার্ড’, ২০১২ সালে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন প্রামাণ্য উৎসব ডক-লাইপজিগের (জার্মানী) ৫৫তম আসরের উদ্বোধনী সিনেমা এবং বিশ্বের বৃহত্তম প্রামাণ্য উৎসব ইডফার (নেদারল্যান্ডস্) ২৫তম আসরে আনুষ্ঠানিক সিনেমার আমন্ত্রণ পেয়েছিল ‘শুনতে কি পাও!’ এ বছরের ‘মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার ‘স্বর্ণশঙ্খ’’ জিতেছে ছবিটি, জিতেছে শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহকের পুরস্কারটিও। বাংলাদেশী ডকুমেন্টারী হিসেবে এত সব আন্তর্জাতিক পুরস্কার আর কয়টা প্রামাণ্যচিত্র জিতেছে? কামার আহমাদ সায়মন-সারা আফরীন, হ্যাটস অফ।

বাংলাদেশে সম্ভবত এটিই প্রথম বানিজ্যিকভাবে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশী প্রামাণ্যচিত্র। চলচ্চিত্রটি ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সালে মুক্তি পেয়েছিলো ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সে। বসুন্ধরার এ হল কতৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই বানিজ্যিকভাবে প্রথমবার প্রামাণ্যচিত্র মুক্তি দিয়ে সাহসী পরিচয় প্রদানের জন্য। ছবিটির অভিষেক প্রদর্শনীতে বিশিষ্ট নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলছিলেন এ ছবিটি সম্পর্কে তার মূল্যায়নের কথা। প্রথমবার নব্বই মিনিটের প্রামাণ্যচিত্রের কথা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন তিনি। ছবিশেষে তিনিই তুষ্টিতে বলেছেন, ‘’মনেই হয়নি আমি প্রামাণ্যচিত্র দেখছি। চরিত্রগুলো এতই প্রানবন্ত যে মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে এটি ফিকশন নয়তো!‘’ সত্যিই, সৌমেন-রাখীর জীবনযাপনের আবডালে দেখানো চরাঞ্চলের মানুষের উপাখ্যানটি দেখার সময় মাঝে মাঝে ভ্রম হচ্ছিলো, এটি কোন ডকুমেন্টারী নাকি কোন ফিকশন! সত্যি বলছি, দর্শক হিসেবে এক সেকেন্ডের জন্যও মনযোগ হটেনি, বরং ঢুকে গিয়েছি প্রত্যেকটি চরিত্র, ঘটনা, প্রকৃতির মাঝে। রাহুল তার গ্রামের ছোট রাস্তায় দৌড়ানোর সাথে সাথে তাকে ফলো করা ক্যামেরা দেখে মনে হয়েছে ছেলেটির পিছনে দৌড়াতে থাকা মানুষটি আমি নিজেই, গ্রামের মাঠে বৃষ্টির মাঝে চলা ফুটবল ম্যাচের সহস্র দর্শকের মাঝে আনমনে কখন ঢুকে গিয়েছি টেরই পাইনি।

লেখক: মোঃ আলতামিশ নাবিল

Loading...