চলচ্চিত্র জিরো ডিগ্রির একটি দৃশ্যে পাগলা গারদে জয়া আহসানের পেছনে ইংরেজী ভাষায় লেখা প্রবাদবাক্যটির বাংলা অনুবাদ এমনটিই দাঁড়ায়! অনিমেষ আইচের জিরো ডিগ্রি যেন জীবন নামের অশান্ত সমুদ্রে গল্পের তিন প্রধান চরিত্রের দক্ষ নাবিক হয়ে অন্তিমে ফুরিয়ে যাওয়ার গল্প।
জিরো ডিগ্রীর মূল চরিত্র তিনটিঃ অমিত (মাহফুজ আহমেদ), নীরা (রুহি) ও সোনিয়া (জয়া আহসান)। সন্তান অর্ককে নিয়ে অমিত ও নীরার সাজানো এক সংসার। “আমি সাদামাটা, আমি হলাম ওপেন বুক যেখানে কোন রহস্য নেই!” অমিতের এই সংলাপের মধ্য দিয়েই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুমেয়। অপরদিকে অমিতের তুলনায় নীরা ততটাই রহস্যময়।
ভালোই কেটে যাচ্ছিলো তাদের সুখের সংসার। তবে পরিচালকের মতে, প্রত্যেকটা সুখের পাশেই একটা অসুখ থাকে। তাইতো স্বামী সন্তান রেখে এক রকস্টারে নিধিদ্ধ প্রেমের টানে নীরা পাড়ি জমায় বিদেশে।
এরপর রোড অ্যাক্সিডেন্টে তাদের সন্তান অর্কের মৃত্যু হলে বউ ও পুত্র হারানোর শোকে অমিতের স্থান হয় পাগলা গারদে। যেখানে আমরা গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র সোনিয়াকে (জয়া আহসান) দেখতে পাই। মাদারীপুরের এক বদমেজাজী দুশ্চরিত্র প্রভাবশালী (তারিক আনাম) এর মেয়ে সোনিয়া ছোটবেলায় তার মাকে তার বাবার হাতে খুন হতে দেখে। বাবার দুঃশাসনে টিকতে না পেরে সৎ মা এর দেয়া কিছু টাকা নিয়ে পাড়ি জমায় ঢাকায়। কর্মস্থলে একের পর এক পুরুষের কামনার শিকার হয়ে অবশেষে এক কবির সাথে প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তার। কিন্তু বিধি বাম, কবি তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে পদ্মার পাড়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে কিছু শরীরভোগীর কাছে। অতঃপর হৃদয়ভাঙ্গা সোনিয়ার শেষ আশ্রয় পাগলা গারদ।
এ পর্যায়ে দর্শকের প্রেডিকশনকে হার মানায় পরিচালকের মুন্সিয়ানা। দুই অসহায় চরিত্রদ্বয়কে পাগলাগারদে তিনি এক করেননি, অন্যসব গতানুগতিক ছবিতে যেটা হওয়াটাই কাম্য ছিলো। সোনিয়া সুস্থ হিয়ে ফিরে যায় প্রতারক কবি ও তার অতীতের বাকীসব শরীরভোগীদের বিচার করতে, অন্যদিকে অমিত খুজে বেড়ায় নীরাকে। এভাবে চলতে থাকে জীবন নামের অশান্ত সমুদ্রে দুই নাবিকের লড়াই।
পরিচালক অনিমেষ আইচকে অভিবাদন, বাংলাদেশী দর্শককে অ্যাকশন রোমান্টিক জেনারের একপেশে বৃত্ত থেকে বের করে এনে সাইকোলজিকাল থ্রিলারের মজাটা উপভোগের সুযোগ দেবার জন্য। মেদমুক্তভাবে গল্প বলাটা কাকে বলে পরিচালক জিরো ডিগ্রী দিয়ে এক তুড়িতে বুঝিয়ে দিলেন। ছবির অন্তিমে কানামাছি খেলার দৃশ্যে পরিচালকের সৃষ্টি এই আবহ আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মানকে ইঙ্গিত করে।
তবে গল্পে চরিত্রগুলোর মধ্যে লিংক সৃষ্টি করার হেতু, কিছু প্রশ্নবিদ্ধ গ্যাপ রয়েই গেল! অতীতের প্রতিশোধ নিয়ে পুলিশের থেকে পালাতে থাকে সোনিয়াকে কিভাবে চিলের মত অমিত এসে তার বাইকে তুলে উদ্ধার করলো সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে পরিচালক যে এটা তিন চরিত্রকে এক সুতোয় গাথার জন্য করেছেন সেটা অনুমেয়।
চলচ্চিত্রটির কিছু গান যেমনভাবে শ্রুতিমধুর কিছু গান তেমনি জ্বালাময়ী। ন্যান্সি ও সন্ধির গাওয়া কিছু কথা দর্শকমনে ভালোবাসার উদ্রেগ করে। উল্টোদিকে জেমসের গলায় প্রেম ও ঘৃনা গানে দর্শকদের মনে বিরহ আর প্রতিশোধের জ্বালা সৃষ্টি হয়। শেষদিকে একটি রবীন্দ্র সংগীতের ব্যবহার সত্যিই প্রশংসনীয়। ও হ্যা, ছবিটিতে ছিলোনা কোন প্রধাগত ফর্মুলার ছাঁচে মাপা আইটেম গান। তাই বলে ছবিটি কি তার বানিজ্যিক আবেদন হারিয়েছে?
অভিনয় বিভাগে আসতে গেলে বলতে হয় প্রত্যেকেই ফুলমার্কস পেয়েছেন। মাহফুজ, জয়ার অভিনয় দিয়ে পরিচালক যেমন দর্শকমনে করুনার আবহ সৃষ্টি করেছেন তেমনি রুহির চরিত্রটিকে ততটাই দিয়েছেন ঘৃনার সুযোগ। টেলি সামাদ তার জীবনের সেরা অভিনয়টি করে ফেলেছেন ড্যান্স মাষ্টার চরিত্রে। কবি চরিত্রে নবাগত মীর রাব্বিও ছিলেন অনবদ্য। এছাড়াও তারিক আনাম, ইরেশ যাকের তার নামের মূল্যায়ন করেছেন পর্যায়।চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহন নিয়ে আলাদা করে না বললেই নয়। বিজ্ঞাপনের মানুষ নেহাল কোরেশি তার এক একটি অনবদ্য ফ্রেম দিয়ে এবারে তাক লাগালেন চলচ্চিত্রের পর্দায়। তার মত চিত্রগ্রাহকদের চলচ্চিত্রে কাজ করাটা আমাদের ইন্ড্রাষ্টির জন্য বড্ড দরকার। লোকেশন, কষ্টিউম ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে ষোলআনা প্রচেষ্টাকে লাল সেলাম।
চারিদিকে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর মধ্যে হিন্দী চলচ্চিত্রের অনুপ্রবেশ আর যৌথ প্রযোজনার একের পর এক রিমেইক সব চলচ্চিত্রের ভিড়ে মৌলিকতার ঠাই নাই তব ঠাই নাই। তবে যুদ্ধের সময়েও তো ফুল ফোটে, পাখি গান গায়। এমন অসময়ে মৌলিক গল্পের ছবি চলচ্চিত্র জিরো ডিগ্রী দর্শকের হৃদয়ে ফুল ফোটাতে, গান শোনানো পারলো কি? উত্তরটা দর্শকরাই দিক।
লেখক: মোঃ আলতামিশ নাবিল