loader image for Bangladeshinfo

শিরোনাম

  • পোশাক শিল্পের সমস্যা সমাধানে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে বস্ত্র উপদেষ্টার আহ্বান

  • নভেম্বরে দেশে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ

  • বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হতে চলেছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা

  • বিএনপি ঐকমত্য চায়, সঙ্গে নির্বাচনী রোডম্যাপ

  • ক্যারিয়ার সেরা র‌্যাংকিংয়ে নাহিদা; উন্নতি পিংকি, জ্যোতি ও সুপ্তার

ভেলকি নয়, ঘোর লাগানো আড়াই ঘন্টা


ভেলকি নয়, ঘোর লাগানো আড়াই ঘন্টা

তুমি যদি বল ভোরের বেলার কাক,

সত্য করা একলা স্টিমার

ফেরিওয়ালার হাক।

লাঠি হাতে ডাকাত সর্দার,

রাত জাগা হাইওয়ের,

ঘুমিয়ে পরা কোন এক ড্রাইভার।

এই শহর আমার

এই মানুষ আমার..

আয়নাবাজি ছবিতে শায়ান চৌধুরী অর্ণবের গাওয়া গান এটি। গানের লিরিকসের মতই ছবিতে ঢাকা শহরের এমন একটা যায়গার গল্প বলা হয়েছে যেখানে এখনও কনক্রিটের ভিড়ে প্রতি সকালে দুধওয়ালা আসে, ফেরিওয়ালা হাঁকডাক দেয়, শিশুরা দলবেঁধে নাটক শিখতে যায়। শহরের ব্যস্ততার ভীড়ে যেখানে এখনো মেলে প্রানের অস্তিত্ব। সেখানে বাস করে শরাফত করিম আয়না (চঞ্চল চৌধুরী) নামের সাধারন এক অভিনয় শিক্ষক কাম পার্টটাইম জাহাজের কুক। তবে গল্প আগালেই আবিস্কৃত হয় আয়নার এসব পরিচয় স্রেফ শুভঙ্করের ফাঁকি। এগুলোর আড়ালে আয়নার বড় পরিচয় সে একজন ক্রিমিনাল। নিজের অভিনয় প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে অন্যের হাঁটাচলা থেকে অঙ্গভঙ্গি সুনিপুণভাবে অনুকরণ করে অন্য দাগী অপরাধীদের হয়ে জেল খাটা হচ্ছে তার কাজ। টাকা আর ক্ষমতার জোড়ে বরাবরই কয়েক মাসের মধ্যে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আয়না কতদিন এভাবে আর পার পেয়ে যাবে। উত্তর মিলবে ছবিতেই।

ছবির কাহিনীতে আরো দেখা মিলবে হৃদি (নাবিলা), ক্রাইম রিপোর্টার সাবের (পার্থ বড়ুয়া), হলিউড স্টুডিওর মালিক চরিত্রে গাউসুল আলম শাওন, অসৎ ব্যবসায়ী চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ সহ আরো অনেকের। অমিতাভ রেজা পরিচালিত ছবিটি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে কন্টেন্ট ম্যাটারস ও হাফ স্টপ ডাউন।

আয়নাবাজি নিয়ে একটু বাড়তি আগ্রহ ছিল বলেই ম্যাস অডিয়েন্স রেসপন্স ধরতে ছবিটি দেখেছিলাম মুক্তির প্রথম দিনেই কাকরাইলের রাজমনি সিনেমা হলে বসে। ঘড়ির কাটায় ৫-১৫, হলে ঢুকে দেখি ততটা ভিড় নেই। তবে ভীড় বাড়লো শো শুরুর আগদিয়ে সন্ধ্যে ৬টায়, পুরো হলটাই একেবারে জমজমাট। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, রাজমনির মত ট্রেডিশনাল ফিল্মপাড়ার হলে অভিনেতা চঞ্চলের এন্ট্রিতে আমি দর্শককে ঠিক ততটাই তালি বাজাতে দেখেছি যতটা দেখেছি এবারের ঈদের বসগিরি’তে হিরো শাকিব খানের এন্ট্রিতে।

বারবার প্রশ্ন উঠছিলো, এতোদিনে আমাদের চলচ্চিত্রের নিজস্ব কোন ভাষা আদৈ তৈরি হয়েছে কি! আয়নাবাজি আমার প্রশ্নটার উত্তর যেন যেচে এসে দিয়ে গেলো। জ্বি হ্যা আমাদের চলচ্চিত্রেরও একটা নিজস্ব ভাষা আছে, তবে আয়নাবাজির মত ছবি প্রতিমাসে হয়না বিধায় আমরা সেই ভাষাটা ভুলতে বসেছি।

ছবির স্টোরিটেলিং, কারিগরি দিক, শিল্প নির্দেশনা, পরিচালনায়, চিত্রগ্রহন এসবের দিক দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম সুনির্মিত ছবি এই ‘আয়নাবাজি’। ছবির কিছু যায়গায় কন্টিনিউটি মিসটেকের মত ছোটখাট কিছু ভুলচুক বাদ দিলে আয়নাবাজী তার নির্মানে ষোলোআনা সফল। টিভি নাটক কিংবা বিজ্ঞাপনে স্টোরিটেলিংটা দারুন করলেও প্রথম সিনেমায় ব্যাপারটা বজায় থাকবেতো? কিছু দর্শকমহল সন্দেহের তীর ছুড়েছিলেন অমিতাভ রেজার দিকে। আমি বলবো দিনশেষে তিনি সফল হয়েছেন এবং সেটা এ-প্লাস মার্ক সমেত। এছাড়াও বিজ্ঞাপন জগতে সিদ্ধহস্ত রাশেদ জামান যেন তার ক্যামেরার চোখ দিয়ে নতুন করে ঢাকা শহরকে দেখিয়েছেন।

ছবির আরেকটি শক্তিশালী দিক এর আবহসঙ্গীত। কোন ছবির আবহসঙ্গীত ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত যিনি আগে কোলকাতার ২২শে শ্রাবণ থ্রিলার ছবির আবহের কাজ করেছেন। তার সুনিপন মিউজিকে ছবির প্রতিটি সিকোয়েন্স পেয়েছে তার নিজস্ব পূর্নতা।

অভিনয় বিভাগে আসলে প্রথমেই নাম করতে হয় আয়না চরিত্রের রুপদানকারী চঞ্চল চৌধুরীকে। নিজের অভিনয়শৈলী দিয়ে পুরো ছবিটা যেন একাই টেনে নিয়ে গেছেন তিনি। রুপকথার গল্প, মনপুরা, মনের মানুষ, টেলিভিশনের পর আয়নাবাজিতে অভিনয় দিয়ে নিজেকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে তিনি। পোষ্টমাষ্টার এর স্বল্প উপস্থিতির চরিত্রকে মিলিয়ে সর্বমোট ৬টি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র রূপদান করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। এই চলচ্চিত্র করতে গিয়ে সাড়ে তিন মাস ভাত খাননি তিনি। বছরশেষে যে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার প্রায় সবগুলো অ্যাওয়ার্ডই তার ঝুলিতে ঢুকবে তা সহজেই অনুমেয়।

উপস্থাপিকা থেকে সরাসরি বড়পর্দায় আবির্ভূত নাবিলা হৃদি চরিত্রে দারুন উৎরে গেছেন। নিজেদের অবস্থানে ঠিকঠাক ছিলেন ক্রাইম রিপোর্টার সাবের চরিত্রে পার্থ বড়ুয়া, লুৎফর রহমান জর্জ, বৃন্দাবন দাশ, গাউসুল আলম শাওন, মিরাক্কেল জামিল সহ প্রত্যেকেই। অবশ্য এ কৃতিত্বের ভাগ ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ অমিতাভ রেজারও প্রাপ্য।

ছবির শেষদিকে নায়ক আরিফিন শুভর ক্যামিও উপস্থিতিতে দর্শকরা নড়েচড়ে বসবেন, অথচ ছবির প্রমোশনে তার গেষ্ট অ্যাপিয়ারেন্সের কোন উল্লেখ ছিলোনা। শুধু এটা নয়, আয়নাবাজিতে এমন আরো চমক আছে। ছবিমুক্তির আগে বাংলাদেশ বনাম আফগানিস্থানের ক্রিকেট ম্যাচের মাঠে আয়নাবাজি টিমের উপস্থিতি বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের প্রমোশনে নতুন  এক মাত্রা যোগ করেছে।

চিরকুট, অর্ণব, হাবিব ওয়াহিদ, ফুয়াদ কিংবা শান.. ছবিতে গাওয়া প্রত্যেকের বিভিন্ন ধাঁচের গান সমান রকমের ভালো।

ছবিতে উল্লেখিত উজবেক ভাষা কিংবা নায়িকার নায়ককে দেয়া প্রেমের হেঁয়ালি সংলাপেও দর্শককে ইন্টারেক্ট করতে দেখেছি, হো হো করে হাসতে দেখেছি। আমাদের ম্যাস অডিয়েন্সও এখন অনেক ম্যাচিউরড সেটা ছবিটি দেখে বুঝলাম।

জেলের ভেতরে কোন ক্রিমিনাল নেই, ক্রিমিনাল থাকে বাইরে। ছবির মূলভাবনা আমাদের সমাজজীবনের অনেকগুলো বিষয়ের উপর অঙ্গুলিনির্দেশ করে। ঢাকার কাঁচাবাজারেও যে রোমান্টিক কোন গানের দৃশ্যায়ন হতে পারে এ ছবি না দেখলে আগে বিশ্বাস হতোনা। ছবি মুক্তির সময় নির্মাতা মহল থেকে প্রত্যেক সাংবাদিককে অনুরোধ জানানো হয়েছিলো ক্রিটিসিজম না করতে। সত্যি বলতে কি, দেশের এমন ভঙ্গুর চলচ্চিত্রাবস্থায় আয়নাবাজির মত এমন সুর্নিমিত ছবি নিয়ে ক্রিটিসাইজ করার মত বিষয় খুব কমই পেয়েছি বটে। ছবির টিমকে ধন্যবাদ জানাই প্রেক্ষাগৃহে ঘোর লাগানো আড়াই ঘন্টা উপহার দেবার জন্যে।

এছবির বিক্রি যে ধরবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে ৭০ টাকার টিকেট ব্লাকে ১০০ টাকায় কেটে ছবিখানা দেখার পর প্রযোজকের পকেটে কতো টাকা ঢোকাতে পারলাম সেটা নিয়ে মনে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। এক ইন্টারভিউতে এ নিয়ে অমিতাভ রেজাকে বলতে শুনছিলাম। দেশের বড় সিনেমা হলগুলো ৩০০টাকার টিকেটে ১৫০ টাকা আগেই কেটে নিচ্ছে ওদের এসি, কার্পেট ইত্যাদি বাবদ। এরপর ৫০ টাকা ট্যাক্স কাটলে থাকছে ১০০ টাকা যেখান থেকে প্রথম সপ্তাহে ৫০%, এরপরে ৩৫% এভাবে করে কোটি টাকা দিয়ে সিনেমা বানিয়ে দিনশেষে প্রযোজক তার লগ্নীকৃত অর্থের কতটা ফেরত নিতে পারছেন তা হিসাব থেকেই স্পর্ষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

দিনশেষে শো-বিজনেস অন্যান্য ব্যবসার মতই একটা লাভ-লসের খেলা। পলিটিকাল থ্রিলার ঘরানার বিনোদনমূলক ছবি আয়নাবাজি নির্মান করে দর্শককে হলে টেনে আনা গেলোতো ঠিকই কিন্তু দেশের হল সংস্কারসহ টিকেটিং সিস্টেমের বৈষম্যের বিষয়গুলো না শুধরানো গেলে শেষমেষ ভালো সিনেমায় অর্থলগ্নীর জন্য প্রযোজক পাওয়া যাবেতো? প্রশ্ন রয়েই গেলো!

লেখক: মোঃ আলতামিশ নাবিল

Loading...