মানুষ কেনো মারা যায় জানিস?
যখন পৃথিবীর কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়,
অথবা তার কাছে পৃথিবীর!
বলছিলাম গত ২৭শে অক্টোবর সারাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ডুব’ চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র জাভেদ হাসানের একটি সংলাপ। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালনায় নির্মিত ডুব আপাত নিরিখে একজন লেখকের জীবনের দাম্পত্য টানাপোড়েনের গল্প। কিন্তু আদতে কি তাই, নাকি এর থেকে বেশী কিছু?
ডুবে জাভেদ হাসান চরিত্রের লোকটি কি সত্যি সত্যি হুমায়ুন আহমেদ? পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে সর্বপ্রথম জানানো হয়, ডুব ছবিতে ইরফান খান অভিনয় করছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রে। আর তিশা ও পার্ণো মিত্র যথাক্রমে শিলা ও শাওন এর চরিত্রে। এরপর এই ইস্যু নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি।
ডুবকে একদিক দিয়ে বললে বলা যায় এটি হুমায়ুন আহমেদের বায়োপিক, আবার এটি বায়োপিকও নয়ও। খ্যাতিমান এই লেখকের জীবনের বড় ঘটনাগুলো ছবির কাহিনীর সাথে মিলে গেলেও ডিটেলিং এর ক্ষেত্রে লেখক জীবনের সাথে ছবির অনেক অংশেরই মিল নেই!
ছবির গল্প মূলত প্রতিতযশা এক চলচ্চিত্র পরিচালককে ঘিরে যার নাম জাভেদ হাসান। যার ঘরে একজন স্ত্রী এবং দুজন সন্তান রয়েছে। জাভেদ যৌবনে তার ষোড়শী প্রেমিকাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। স্ক্যান্ডালহীনভাবে পরিবার, তার ফিল্মমেকিং ক্যারিয়ার পার করার কোন এক পর্যায়ে গিয়ে তিনি এক তরুনীর প্রেমে পড়েন যে তার মেয়ের বন্ধু।
ভালোবাসা জিনিসটা মানবের জীবনকালে প্রকাশিত হয় এবং মৃত্যুর পরে তা ক্রমে বিলুপ্ত হয়। কিন্তু জীবদ্দশায় বিলুপ্ত ভালোবাসা মৃত্যুতে কিভাবে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে সেটার উল্লেখ আছে ডুবে। জাভেদ হাসানের সাজানো গোছানো পরিবারটি হয়তোবা অর্থের স্থান থেকে উচ্চবিত্তের জায়গায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু তাদের আবেগ ষোলআনা মধ্যবিত্তের। সেই দিক দিয়ে বলা যায় এটি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের আবেগের গল্প, ভালোবাসার গল্প।
টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত
ডাকতে ডাকতে একশেষ;
কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না
এই হিমঘরে ভাঙা চেয়ারে একা বসে আছি।
এ কী শান্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশ্বর,
এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা!
মহাদেব সাহার ‘মন ভালো নেই’ কবিতার সাথে অনেকটার যেন মিলে যায় জাবেদ হাসানের জীবন। একখণ্ড পাহাড়, লেক, বন, সবুজ, লিলুয়া বাতাস.. চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহনে এসবের উপস্থিতি দর্শকের মনে একটা শূন্যতা সৃষ্টি করে, একপ্রকারের হাহাকারের জন্ম দেয়। আর এর মধ্যে যুক্ত হওয়া চিরকুটের গাওয়া ছবির একমাত্র গান ‘আহারে জীবন’ এই হাহাকারের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের কিংবদন্তী লেখক হুমায়ুন আহমেদ যে গল্প-উপন্যাসগুলো লিখেছিলেন সেগুলো তার জীবন কিংবা জীবনের আশপাশ থেকে নেয়া তাতে কোন দ্বিমত নেই। গল্পের কাজ গল্পের উৎস নিয়ে ভাবা নয়, কারন উৎস সত্য হলেও গল্প তো আর সত্য নয়। এ প্রসঙ্গে পরিচালকের একটি লাইন খুব মনে ধরেছিলো, তিনি ছবিমুক্তির সময়ে কোন এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘যদি আপনি ভাবেন ছবিতে যদি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে মিল থাকে তাহলে আছে। আর কারও কাছে যদি মনে হয় নেই, তাহলে নেই!’ তিনি যদি ছবিটির প্রচারের সময় এতে হুমায়ুন আহমেদের ট্যাগ লাগাতেন তাতে এটি নিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা কমতোনা বৈকি আরো বাড়তো বটে!
ডুবকে দশে কত দেবেন? এই সহজ প্রশ্ন কঠিন একটা জবাবে শেষ করতে হয়। একটি পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্র হিসেবে ডুবকে আমি দশে নয় দেব! কিন্তু এই সাবকনটিনেন্টের বেয়াড়া মন যে আরো কিছু চায়। এই উপমহাদেশে চলচ্চিত্র মানেই এন্টারটেইনমেন্ট, এন্টারটেইনমেন্ট এবং এন্টারটেইনমেন্ট। সেই প্রেক্ষাপটে ডুব টেনেটুনে দশে চার পেলে পেতেও পারে। এই ছবিটে নাচ-গানের মত কর্মাশিয়াল এলিমেন্ট নেই, ছবিতে আর্ট থাকলেও তথাকথিত আর্ট ফিল্ম ঘরানার রগরগে যৌন দৃশ্য নেই। ছবির অনেক অংশে তথ্য দেয়া হয়েছে ইশারায়, চিত্রনাট্যের অনেক কিছুই এখানে ইমপ্লাইড। সাইলেন্স ইজ এ বিগ ক্যারেকটার ইন দিস ফিল্ম। শব্দহীনতা নিজেই এখানে একটা চরিত্র। ঋত্বিক ঘটকের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো’র চর্চা নেই বলেই হয়তোবা ছবিমুক্তির পরপর মানুষকে ছবিটি নিয়ে কটাক্ষ করতে দেখা গেলো। উইথ ডিউ রেসপেক্ট টু দেম, আমার ছবিটা মনে ধরেছে। মনে ধরার মত যথেষ্ট উপকরন ছবির মধ্যে ছিলো।
তবে ছবির কিছু দৃশ্যে কানে একটা ভয়াবহ পীড়া দিয়েছে ইরফান খানের অবাঙ্গালী অ্যাকসেন্টের বাংলা। শেষমেষ হলিউড-বলিউড কাপানো এই অভিনেতার ব্যক্তিত্ব, পর্দায় উপস্থিতিটাই এত গাম্ভীর্যময় ছিলো যে উচ্চারনের ব্যাপারটা শেষমেষ ইগনোর করে যেতে হয়েছে। দর্শক হিসেবে সরয়ার ফারুকী নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে ‘টেলিভিশনের’ পরেই আমি স্থান দেব ‘ডুব’কে।
আমার দৃষ্টিকোনে ডুব এমন একটি শুন্যতার ছবি, বিষাদের ছবি! এই ছবি দর্শককে বিষাদবিলাসী হতে শেখায়, দর্শককে বিষাদে আক্রান্ত করে এর সমুদ্রে অবগাহন করায়। বিষাদ নিয়ে মহাদেব সাহার কবিতার আরো দুটি লাইন বিড়বিড়িয়ে তবে বাড়ি ফেরা যাক।
বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই..
লেখক: মোঃ আলতামিশ নাবিল