বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ত্রয়োদশ প্রয়াণ দিবস ১২ সেপ্টেম্বর। ২০০৯ সালের এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। প্রতিবছর বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে দিবসটি পালন করা হলেও, এবার সিলেটে বন্যা-পরবর্তী প্রতিকূলতার কারণে সেটি হচ্ছে না। অবশ্য, পারিবারিক ও ঘরোয়া আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাউল সম্রাটকে স্মরণ করছেন তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা।
শাহ আব্দুল করিম ইব্রাহিম আলী ও নাইওরজানের ঘরে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে পড়ালেখার সুযোগ হয়নি আব্দুল করিমের। অবশ্য, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও করিম ছিলেন স্বশিক্ষিত। প্রতিদিনের জীবনের জাগতিক সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসাকে আপন মহিমায় তুলে ধরেছেন তাঁর বাউল গানে। গানে গানে স্মরণ করেছেন স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন স্বাধিকার আন্দোলনে বাউল সম্রাটের গান বাঙালীকে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। মরমী গান আর হৃদয় ছোঁয়া সুর তাঁকে হাওরের রাখাল বালক থেকে বাউল সম্রাটের আসনে আসীন করেছে।
শাহ আব্দুল করিমের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে – ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘রঙের দুনিয়া তরে চায় না,’ ‘তুমি রাখ কিবা মার’, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ুরপংখী নাও’, ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো’সহ অনেক গান।
বাউল শাহ আব্দুল করিমের এ-পর্যন্ত সাতটি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে তাঁর রচনাসমগ্র (অমনিবাস)-এর মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এছাড়া, সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত শাহ আব্দুল করিম স্মারকগ্রন্থ (অন্বেষা প্রকাশন) তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। এর আগে-পরে শাহ আব্দুল করিমকে নিয়ে সুমনকুমার দাশের ‘বাংলা মায়ের ছেলে: শাহ আবদুল করিম জীবনী’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘সাক্ষাৎকথায় শাহ আব্দুল করিম’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘শাহ আবদুল করিম’ (অন্বেষা প্রকাশন), ‘বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম’ (উৎস প্রকাশন), ‘গণগীতিকার শাহ আবুল করিম’ (উৎস প্রকাশন) প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ‘প্রথমা’ থেকে প্রকাশিত হয় সুমনকুমার দাশের ‘শাহ আব্দুল করিম: জীবন ও গান’ বইটি। বইটিতে করিমের নির্বাচিত বেশ কিছু গানও সংকলিত হয়েছে।
শাহ আব্দুল করিমের জীবনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস সাইমন জাকারিয়া রচিত ‘কূলহারা কলঙ্কিনী’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে।
বইয়ের তালিকা: আফতাব সঙ্গীত (১৩৫৫ বাংলা; আনুমানিক ১৯৪৮), গণসঙ্গীত (১৯৫৭) কালনীর ঢেউ (১৩৮৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন; ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর), ধলমেলা (১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ১ ফাল্গুন; ১৯৯০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি), ভাটির চিঠি (১১ বৈশাখ ১৪০৫; ২৪ এপ্রিল ১৯৯৮), কালনীর কূলে (নভেম্বর ২০০১), শাহ আব্দুল করিম রচনাসমগ্র (সংকলন ও গ্রন্থন: শুভেন্দু ইমাম, ২২ মে ২০০৯)।
শাহ আব্দুল করিম ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমি তাঁর দশটি গানের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছে। শাকুর মজিদ তাঁকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘ভাটির পুরুষ’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র। এছাড়া, সুবচন নাট্যসংসদ তাঁকে নিয়ে শাকুর মজিদের লেখা ‘মহাজনের নাও’ নাটকের ৮৮টি প্রদর্শনী করেছে।
বাউল সম্রাটকে একুশে পদক (২০০১), কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরী পদক (২০০০), রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০০), লেবাক অ্যাওয়ার্ড (২০০৩), মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার আজীবন সম্মাননা (২০০৪), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস আজীবন সম্মাননা (২০০৫), বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬), খান বাহাদুর এহিয়া পদক (২০০৮), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা (২০০৮), হাতিল অ্যাওয়ার্ড (২০০৯), এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা (২০০৯) প্রভৃতি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
শাহ আব্দুল করিম ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সিলেটের একটি ক্লিনিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় বাউল সম্রাটের স্মৃতি যাদুঘরের ভবন ও সংগ্রহশালার বিভিন্ন উপকরণের ক্ষতি হয়েছে। শাহ আব্দুল করিমের নিজ বসতভিটায় রেখে যাওয়া সংগীত বিদ্যালয়ের সংস্কার এবং প্রস্তাবিত বাউল একাডেমি নির্মাণে সরকার সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন সংগীত অনুরাগীরা।
