শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) ১৪৩০ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হবে নতুন বছর – ১৪৩০। এর আগের দিন বাংলার চিরায়ত উৎসব, চৈত্র মাসের শেষ দিন চৈত্র-সংক্রান্তি উদযাপন করা হয়। জীর্ণ-পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, ‘মুছে যাক গ্লানি’ এভাবে বিদায়ী সূর্যের কাছে এই আহ্বান জানায় বাঙালি। পহেলা বৈশাখ আমাদের সকল সঙ্কীর্ণতা, কুপমুণ্ডকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। মনের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে নতুন উদ্যমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি – পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্য এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সার্বজনীন লোকউৎসব। এই দিনে নতুন বছরকে আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয়। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপন করা হয় নববর্ষ। এবারও বর্ণিল উৎসবে মাতবে দেশ। ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। রাজধানী ও দেশজুড়ে থাকবে বর্ষবরণের নানা আয়োজন।
‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩০’ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। ছায়ানট বরাবরের মতোই ভোরে রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় নববর্ষ পালন করবে।
নববর্ষের অনুষ্ঠান আবশ্যিকভাবে জাতীয় সংগীত ও ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হবে। বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস ও ইউনেস্কো কর্তৃক এটিকে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে এদিন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করেছে। এদিন সকল কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার ও ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে।
এক সময় নববর্ষের প্রথম দিনটি পালন করা হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির। কারণ, কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। পরে, কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা সন গণনা করা শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরি একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ-উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাঁদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত সেই অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয় দেশজুড়েই।
মূলত বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ‘ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় ‘বঙ্গাব্দ’ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এ-সময় ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে।
কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন আর শুধুই আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়; বরং এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে।
নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে প্রথম বের হয়, যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা পায়।
স্কুল-কলেজে নববর্ষ উদযাপনের নির্দেশ
দেশের সব মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে জাতীয় সংগীত ও এসো হে বৈশাখ গান পরিবেশনের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১১ এপ্রিল মঙ্গলবার দেশের সব স্কুল ও কলেজে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছে।
এর আগে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে ও যথাযথ আড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করার নির্দেশ জারি করেছে।
দেশের সব মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে শিক্ষার্থীদের নিয়ে নববর্ষের সকালে আবশ্যিকভাবে র্যালি বের করারও নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
