loader image for Bangladeshinfo

শিরোনাম

  • লিভারপুল হারলো এভারটনের কাছে, ম্যানইউ-এর শেফিল্ড-বাধা অতিক্রম

  • শুরু হলো স্বাধীনতা দিবস জিমন্যাস্টিক্স প্রতিযোগিতা ২০২৪

  • জাভি এই মৌসুম শেষেই বার্সা ছাড়বেন না

  • নতুন করে আরও ৭২ ঘণ্টার তাপ প্রবাহের সতর্কতা জারি

  • ইতালিয়ান কাপের ফাইনালে ইউভেন্টাস

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব


কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব

‘বাউল সম্রাট’ ফকির লালন শাহ্ এর আখড়াবাড়িটি করোনা-নিষেধাজ্ঞায় ২০২০ সাল থেকে টানা দুই বছর ছিল নিষ্প্রাণ। তালাবদ্ধ ছিল এর মূল ফটক। বারবার প্রাণের টানে আখড়াতে এসেও ফিরে গেছেন লালনের অনুসারী, ভক্ত, বাউলেরা। সেই সংকট কাটিয়ে আবারও কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব শুরু হচ্ছে মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) থেকে। অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে আবার প্রাণ ফিরেছে হাজারো বাউল-সংস্কৃতির জনপদের এই তীর্থভূমিতে। লালনকে বলা হয় বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম, ‘বাউল সম্রাট’। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। লালনের গানের মধ্য দিয়েই উনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল গানকে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যগুলোর মাঝে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। আখড়াবাড়িই ছিল বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্ এর প্রধান অবস্থান এবং এখানেই তিনি জীবনের শেষ প্রয়াণ নেন। বর্তমানে সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে লালন একাডেমি। এখানে লালন সমাধিস্থলকে স্মরণীয় করতে ১৯৬২ সালে একটি সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছে।

জেলার ছেঁউড়িয়ায় বাউল সম্রাট লালন সাঁই’র আখড়াবাড়িতে দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) থেকে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্ এর এই আধ্যাত্মিক ও দেহতত্ব গানের মধ্যে দিয়ে মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়ে এই উৎসব চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। করোনার কারণে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় পরে টানা দুই বছর কুষ্টিয়ায় ছেঁউড়িয়ায় বাউল সম্রাট লালন সাঁই’র আখড়াবাড়িতে তিরোধান দিবস ও দোলপূর্ণিমা উৎসব উৎসব বন্ধ ছিল। মহামারি-সংকট কাটিয়ে আবারও ছেঁউড়িয়ায় বসছে দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে লালন স্মরণোৎসব। এদিন সন্ধ্যায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ও লালন একাডেমির উদ্যোগে তিনদিনের দোলপূর্ণিমা উৎসবটি উদ্বোধন করা হবে।

বাউল সম্রাট লালন সাঁই তাঁর জীবদ্দশায় ছেঁউড়িয়ার এই আখড়াবাড়িতে প্রতি বছর চৈত্রের দোল পূর্ণিমা রাতে বাউলদের নিয়ে সাধুসঙ্গ উৎসব করতেন। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক তাঁর মৃত্যুর পরও এই উৎসব চালিয়ে আসছেন তাঁর অনুসারীরা। কিন্তু করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ ছিল আয়োজন। এবার সংস্কৃতিকবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন একাডেমি তিন দিনের এই দোলপুর্ণিমা উৎসবের আয়োজন করেছে। ইতোমধ্যে এই উৎসবকে ঘিরে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার কালী নদীর তীরে লালন আঁখড়াবাড়িতে শেষ হয়েছে গ্রামীণ মেলার প্রস্তুতি। সেইসঙ্গে দুই বছর পরে সাধু ভক্তরা লালন মাজারে আসতে পারবেন বলে তাঁরা খুশি । তিন দিনের এই আয়োজনে সাধুদের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে আয়োজকরা।

প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিট থেকে লালন মুক্তমঞ্চে আলোচনা সভা এবং পরে বাউল গানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম দিনের আলোচনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন, এনডিসি। বুধবার দ্বিতীয় দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাংস্কৃতিকবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বৃহস্পতিবার শেষ দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মাহাবুব উল আলম হানিফ। তিন দিনের আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও লালন একাডেমির সভাপতি মো. সাইদুল ইসলাম। সেই সঙ্গে উৎসব চলাকালীন সময়ে প্রতিদিন আলোচনা সভা শেষে দেশবরেণ্য লালন গানের শিল্পী, লালন একাডেমির শিল্পীসহ গুণী সংগীত শিল্পীবৃন্দ গান পরিবেশন করবেন বলে জানা গেছে।

ডিসি সাইদুল ইসলাম  জানান, তিন দিনব্যাপী এই লালন স্মরণোৎসবকে ঘিরে ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), সাদা পোশাকে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন।’ 

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের এই আখড়াবাড়িই ছিল বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্এ-র প্রধান অবস্থান এবং এখানেই তিনি শেষ প্রয়াণ নেন। তবে, বর্তমান সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে লালন একাডেমি। এখানে লালন সমাধিস্থলকে স্মরণীয় করতে ১৯৬২ সালে একটি সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছে। 

ভক্ত, আশেকান, অনুসারী ও শিষ্যদের মতে, লালনকে তরুণ বয়সে রোগাক্রান্ত ও অচেতন অবস্থায় ছেঁউড়িয়া গ্রামের কালীগঙ্গার পূর্বপাশের তীরে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় মলম কারিকর ও তাঁর স্ত্রী মতিজান অন্যদের সাহায্যে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। বাড়িতে এনে অসুস্থ লালনকে সেবা-যত্ন করে সুস্থ করে তোলেন। এভাবে সান্নিধ্য লাভের মধ্যদিয়ে মলম কারিকর নিজেও লালন সাঁইয়ের অনুসারী হয়ে উঠেন।

লালনের কন্ঠে আধ্যাত্নিক কথার গানে স্থানীয় মাওলানা, হাফেজ লালনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। পরে, সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা লাভের পরে মলম কারিকর তাঁর ভূসম্পত্তির একটা অংশ লালনকে লিখে দেন। একইসঙ্গে মলম কারিকর অনুরোধ ও গুরু সিরাজ সাঁইয়ের নির্দেশক্রমে লালন এই ছেঁউড়িয়া গ্রামে নির্মিত কুঁড়েঘরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন, যা আজকের ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়ি নামে পরিচিতি পেয়েছে দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বময়। 

লালনের জীবদ্দশায় একজন বিধবা নারীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন আখড়াবাড়িতে, যিনি পরে লালনের স্ত্রী রূপে এবং বিশাখা নামে পরিচিতি পান। লালন ফকির প্রতি বছর শীতকালে মহোৎসব করতেন, এবং সেই উৎসবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভক্ত আশেকান সাধু বাউল ফকিররা মিলিত হতো। ওই উৎসবকে ঘিরে সেখানে বাউল গানের আসর হতো এবং লালন ও তাঁর স্ত্রী পরিচয়ধারী বিশাখাও সেই জলসায় অংশ নিতেন। সেখানে সব গানই মূলত লালন নিজেই রচনা ও সুর সংযোজন করতেন, যা পরে তাঁর শিষ্য-অনুসারীরা রপ্ত করতেন। 

লালনের জন্ম-সংক্রান্ত তথ্যানুযায়ী, সঠিক সময়কাল শনাক্তকরণ সম্ভব না হওয়ায় তিনি জীবদ্দশায় প্রকৃত অর্থে কত বছর বেঁচে ছিলেন – তা নির্ণয় করা যায়নি। তবে, তিনি যে একজন দীর্ঘায়ু ব্যক্তি হিসেবে বেঁচে ছিলেন, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে শিষ্য-অনুসারীদের ধারণা। 

তৎকালীন সময়ে শিলাইদহের জমিদার জ্যেতিরিন্দ্রনাথ ২৩ বৈশাখ ১২৯৬ বঙ্গাব্দে (৫ মে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ) পঞ্চবোটে রবীন্দ্রনাথসহ পরিবারের অন্যদের সামনে চেয়ারে বসিয়ে লালন ফকিরের একটি স্কেচ তৈরি করেন। স্কেচটি রবীন্দ্রভারতী সোসাইটিতে রক্ষিত আছে এখনও। তাঁর একটি ফটোকপি ও শিল্পী সহিদ হোসেন কর্তৃক উক্ত স্কেচের একটি নকল লালন একাডেমিতেও রক্ষিত আছে। আচার্য নন্দলাল বসু কর্তৃক লালন ফকিরের স্কেচটি শ্রী শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর নির্দেশে কাল্পনিকভাবে অংকিত হয়। 

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্কেচটি অংকনের এক বছর পরে ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর) মৃত্যুবরণ করেন লালন ফকির। তৎকালীন কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকারী নামক পাক্ষিক পত্রিকায় লালন ফকিরের তিরোধানের ওপর রচিত সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। ওই সম্পাদকীয় লেখার বিবরণানুযায়ী, মৃত্যুকালে লালনের বয়স হয়েছিল ১১৬ বছর। লালন ফকির মৃত্যুকালের এক মাস আগে থেকে পেটের অসুখে পীড়িত হন এবং হাতপায়ের গ্রন্থি জলস্ফীত হয়। পীড়িত অবস্থায় দুধ ছাড়া অন্য কিছু খান নাই। তবে, মাঝে মধ্যে কিঞ্চিৎ মাছ খেতে পছন্দ করতেন। লালন ফকির মৃত্যুর পূর্ব রাতেও ভক্ত শিষ্যদের সঙ্গে গান করেছেন এবং ভোর পাঁচটার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

লালন শাহ্ এর ইচ্ছা ও পূর্ব নির্ধারিত ঘরেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ছেঁউড়িয়াতে তাঁর সমাধির পশ্চিম পাশে মলম সাহের স্ত্রী মতিজানেরও সমাধি রয়েছে। লালন শাহ্’র স্ত্রী বিশাখা স্বামীর মৃত্যুর পরে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং তিনি মৃত্যুবরণ করলে লালন শাহ্’র সমাধির দক্ষিণ পাশের তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

লালন ফকির দীর্ঘ সময়কাল ধরে তাঁর নিজস্ব আত্মদর্শনের আলোকে ভক্ত আশেকান ও শিষ্যদের নিয়ে যেসব উৎসব মুখর কর্মকাণ্ড করতেন, তারই ধারাবাহিকতায় আজও দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভক্ত-শিষ্য অনুসারীরা বছরের দুইটি দিন - দোলউৎসব এবং পহেলা কার্তিক সাঁইজির তিরোধান দিবস পালন করতে মিলিত হয়ে থাকেন এই সাধনতীর্থ ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে। এসব উৎসবে লালনের রেখে যাওয়া মানবমুক্তির সহস্রাধিক আধ্যাত্মিক বাণীসম্বলিত গান গাওয়া হয়। সেইসঙ্গে আখড়াবাড়ি সংলগ্ন কালীগঙ্গা মাঠে বসে উৎসবমুখর গ্রামীণ মেলা।

(সংকলিত)

Loading...